সহজ ভাষায় লেখা পুতুলনাচের ইতিকথা (উপন্যাস)
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
খালের ধারের প্রকাণ্ড বটগাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে হারু ঘোষ দাঁড়িয়ে ছিল। আকাশের দেবতা তার দিকে তাকিয়ে কটাক্ষ করলেন।
![]() |
পুতুলনাচের ইতিকথা (উপন্যাস) মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় | জনপ্রিয় উপন্যাস | BongoCyber |
হারুর মাথার কাঁচা-পাকা চুল আর বসন্তের দাগভরা রুক্ষ ত্বক যেন জ্বলে-পুড়ে গেল। তবে সে কিছুই টের পেল না। শতাব্দী প্রাচীন সেই বটগাছের সঙ্গে তার একান্ন বছরের আত্মমগ্ন জগৎটি যেন চোখের পলকে মিলিয়ে গেল।
কটাক্ষের পর আকাশের দেবতা দিগন্ত কাঁপিয়ে এক হুঙ্কার ছাড়লেন, আর সাথে সাথে ঝড়ো বৃষ্টি এসে হাজির হলো।
বটগাছের ঘন পাতাও বেশিক্ষণ বৃষ্টি ঠেকাতে পারল না। হারু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল, সে ভিজে যাচ্ছে। জায়গাটির ঝাঁঝালো সামুদ্রিক গন্ধ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে লাগল, আর কাছের ঝোপ থেকে কেয়ার মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল।
সবুজ রঙের সরু একটা সাপ এক কেয়াকে পেঁচিয়ে ধরেছিল, কিন্তু বৃষ্টির পানিতে গা ভিজতেই সে প্যাঁচ খুলে ধীরে ধীরে ঝোপের বাইরে চলে এলো। কিছুক্ষণ কুটিল চোখে হারুর দিকে তাকিয়ে থেকে তার পায়ের ফাঁক দিয়ে বটগাছের কোটরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
হারুকে এখানে কেউ সহজে খুঁজে পাবে না, এমন সম্ভাবনা খুব কম। এদিকে মানুষের বসতি নেই। সাধারণত কেউ এই পথ মাড়ায় না।
গ্রামের লোকজন ভয় পেতে ভালোবাসে। খালের এপাড়ের ঘন জঙ্গল আর গভীর নির্জনতাকে তারা নিজেদের ভয়ের কল্পনায় রূপ দিয়েছে। ভূত-প্রেতের অস্তিত্ব হয়তো তাদেরই ভয়াল মনের সৃষ্টি, তবে জায়গাটি যে সাপের রাজ্য, তা নিয়ে সন্দেহ নেই।
দিনের আলো থাকতেই বাজিতপুরের দু-একজন সাহসী পথিক মাঠ পেরিয়ে ঘাসের নিচে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া সরু পথ ধরে যাতায়াত করে। কোনো নৌকায় খাল পার হলেই গাওদিয়ার সড়ক। গ্রামের পৌঁছতে আধ মাইলও হাঁটতে হয় না। চণ্ডীর মা মাঝে মাঝে দুপুরবেলা কাঠ কুড়াতে আসে। কবিরাজ যামিনীর চেলা সপ্তাহে একবার এই পথে গুল্মলতা কুড়াতে আসে। কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে ভিনগাঁয়ের সাপুড়ে এসে সাপ ধরে নিয়ে যায়। আর অন্য কেউ ভুল করেও এদিকে আসে না।
বৃষ্টি থামতে বিকেল গড়িয়ে এলো। আকাশের একপ্রান্তে লজ্জাশীল রঙের একটি আভা দেখা দিল। বটগাছের ডালে পাখিরা ফিরে এলো, আর কিছু দূরে মাটির গর্ত থেকে উইপোকাগুলো পাখা মেলে আকাশে উড়তে শুরু করল। পাখিরা তাদের দেখে আবার সেই দিকেই ছুটে গেল।
হারুর নি:স্পন্দ অবস্থায় সাহস পেয়ে কাঠবিড়ালীটি নিচে নেমে এলো। ওদিকে, বুঁদিগাছের জালে এক গিরগিটি কিছুক্ষণের মধ্যেই অনেকগুলো পোকা ধরে ফেলল।
একটি শিয়াল, মুখে মরা শালিকের বাচ্চা নিয়ে, হারুর পাশ দিয়ে যেতে যেতে বারবার ফিরে তাকাল। ওরা বুঝতে পারে। কেমন করে বোঝে, তা কেউ জানে না!
👇 Please Subscribe Our YouTube Channel 👇
0 Comments
Please Do Not Enter Any Spam Link In The Comment Box.