Adds

টাকা দিয়ে যাকাতুল ফিতর আদায় করা যাবেনা কেন? এ বিষয়ে শরীয়তসম্মত ১০টি কারণ।

BongoCyber blog


প্রশ্ন: টাকা দিয়ে যাকাতুল ফিতর আদায় করা যাবেনা কেন? এ বিষয়ে শরীয়তসম্মত ১০টি কারণ। সাথে রায়পন্থিদের (হানাফিদের) জন্য কিছু এন্টিভেনাম। সম্পাদনায় ❝শাইখ আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল❞ আল মাদানী (হাফিঃ)।


ভূমিকা: শরীয়তের বিধানের কারণ খোঁজা অনুচিত। বরং, বিনা প্রশ্নে মেনে নেওয়ার মধ্যেই মানুষের কল্যাণ রয়েছে। মুমিন তো তারাই, যারা বলে, "আমরা শুনেছি এবং মেনে নিয়েছি" (সূরা বাকারা: ২/২৮৫)। টাকা দিয়ে ফিতরা আদায় করার পক্ষে কোনো দলিল পাওয়া যায়নি, তাই এখন যুক্তি দিয়ে এ বিষয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। তবে সত্য চিরকালই সত্য, আর মিথ্যা চিরকাল মিথ্যাই থাকে। যাকাতুল ফিতর টাকা দিয়ে আদায় করা কেন বৈধ নয়? আসুন ১০টি পয়েন্টে বিস্তারিতভাবে এ বিষয়ে আলোচনা করি, ইনশাআল্লাহ।

১. ইবাদতের শর্ত: পৃথিবীর সকল ইমাম একমত যে, ইবাদত কবুল হওয়ার জন্য দুটি মৌলিক শর্ত রয়েছে:


(ক) ইবাদত একনিষ্ঠভাবে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হতে হবে (সূরা কাহফ: ১৮/১১০)।

(খ) ইবাদত অবশ্যই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর পদ্ধতি অনুযায়ী হতে হবে। ইখলাস বা আন্তরিকতা থাকলেও যদি ইবাদত রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাত অনুযায়ী না হয়, তা গ্রহণযোগ্য হবে না (সূরা আলে ইমরান: ৩/৩১)।


ইমাম ইবনু কাছীর ব্যাখ্যা করেছেন, আমল তখনই গ্রহণযোগ্য হবে যখন তা আল্লাহর জন্য খালেস এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শরীয়ত মোতাবেক হবে। যদি এই দুটি শর্তের কোনো একটি বাদ পড়ে, তাহলে সেই আমল বাতিল হবে (তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, ৪র্থ খণ্ড, পৃঃ ৩০৮)।


২. ইবাদতের মৌলিক নীতিমালা: ইবাদতের ক্ষেত্রে শরীয়তের মূলনীতি হলো তা অবশ্যই দলিলনির্ভর হতে হবে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে প্রমাণিত না হওয়া কোনো ইবাদত করা জায়েজ নয়। যেহেতু শরীয়তপ্রণেতা কর্তৃক অর্থ দিয়ে ফিতরা আদায়ের প্রমাণ নেই, তাই এমনটি করা শরীয়ত সম্মত নয় (ইমাম বিন বায মাজমূ‘উ ফাতাওয়া, খণ্ড: ১৪, পৃষ্ঠা: ২০৮)।


৩. আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের নীতি: শরীয়তের হুকুম প্রদানের ক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের নীতি হচ্ছে, আল্লাহর কিতাব এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্নাহ অনুযায়ী চলা। নাবী (ﷺ) বলেন, "তোমরা আমার সুন্নাত এবং আমার খলীফাদের সুন্নাত অনুসরণ করবে" (আবু দাঊদ হা/৪৬০৭)।


৪. রাসূল (ﷺ)-এর যুগে অর্থ ছিল, কিন্তু তা দিয়ে ফিতরা আদায় করা হয়নি: রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর যুগে অর্থের প্রচলন ছিল, তবুও ফিতরা খাদ্য দিয়েই আদায় করা হয়েছে। প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও অর্থ দিয়ে ফিতরা আদায়ের কোনো উদাহরণ নেই। তাই আজকের দিনে অর্থ দিয়ে ফিতরা আদায় করা শরীয়তের মূলনীতির বিরুদ্ধে যায়।


৫. আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী ত্ব’আম (খাদ্য) দিতে হবে: কুরআনে ফিদিয়া, কাফফারা এবং যাকাতুল ফিতর ক্ষেত্রে ত্ব’আম অর্থাৎ খাদ্য প্রদানের কথা বলা হয়েছে। এখানে অর্থ প্রদান করার কোনো বৈধতা নেই (সূরা বাকারা: ১৮৪, সূরা মায়েদা: ৮৯)।


৬. রাসূল (ﷺ)-এর নির্দেশ খাদ্য প্রদানের বিষয়ে: সাহাবীদের সময় থেকে বিশুদ্ধ হাদিসে স্রেফ খাদ্য প্রদানের কথা এসেছে। অর্থ বা টাকার কোনো উল্লেখ নেই। রাসূল (ﷺ) ফিতরাকে ‘মিসকিনদের জন্য খাদ্য’ বলেছেন, সাদাকা বা অর্থ বলেননি।


৭. ‘সা’ (পরিমাপ) এবং টাকার বিভ্রান্তি: ফিতরা আদায়ের জন্য ‘সা’ পরিমাপ করা হয় খাদ্য দিয়ে, টাকা দিয়ে নয়। শরীয়তের উদ্দেশ্য খাদ্য প্রদান, টাকা নয়। মুয়াবিয়া (রাঃ)-এর ইজতিহাদ ছিল ব্যক্তিগত এবং এটি সর্বসম্মত ছিল না।


৮. আহলে সুন্নাহর অনুসারীদের জন্য আহ্বান: আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের মূলনীতি অনুযায়ী কিতাব, সুন্নাহ এবং ইজমার বাইরে কোনো মতামত গ্রহণযোগ্য নয়। টাকার মাধ্যমে ফিতরা আদায় করা এই নীতির বিরুদ্ধে যায়।


৯. ফকীর-মিসকিনের প্রয়োজন: টাকা দিয়ে ফিতরা আদায়ের অজুহাত দেওয়া হয় ফকীর-মিসকিনদের আর্থিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য। অথচ শরীয়তে যাকাত ও অন্যান্য দান-সাদাকা দিয়ে এই প্রয়োজন পূরণ করা যায়। তাই ফিতরার বিধানে টাকার অজুহাত অপ্রাসঙ্গিক।


১০. ইসলামের পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা: ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যেখানে সালাত, যাকাত, হজ্জ, সাদাকা সহ সকল ইবাদতের পদ্ধতি স্পষ্টভাবে নির্ধারিত। এ বিষয়ে কোনো নতুন সংযোজন বা পরিবর্তনের সুযোগ নেই। বিদ‘আত বলে যা গণ্য করা হয় তা ইবাদতের প্রকৃত অর্থকে বিকৃত করে।


সুতরাং, ফিতরা শুধুমাত্র খাদ্য দিয়েই আদায় করতে হবে, টাকা দিয়ে নয়।


১১. কিছু অন্ধ মুকাল্লিদ (বিশেষত হানাফি) যাঁরা টাকা দিয়ে ফিতরা আদায়ের প্রমাণ খুঁজে পান না, মাজহাব ধরে রাখার জন্য নতুনভাবে যুক্তি তৈরি করেন। তাঁরা দাবি করেন, হাদীসে পাঁচ ধরনের খাদ্যের কথা বলা হয়েছে এবং এর বাইরে অন্য কোনো খাদ্য বা দেশের প্রধান খাদ্য দিয়ে ফিতরা আদায় করা সুন্নাত। তাঁদের উদ্দেশে বলব, দেশের প্রধান খাদ্য দিয়ে ফিতরা আদায় করা যে সুন্নাত, তা পবিত্র কুরআন ও হাদীস উভয়েই প্রমাণিত। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন: "যাদের জন্য সিয়াম রাখা কষ্টকর হয়, তাদের কর্তব্য হলো এর পরিবর্তে একজন মিসকীনকে খাদ্য প্রদান করা।" 

(সূরা আল-বাক্বারাহ; ২:১৮৪)। এই আয়াতে স্পষ্টভাবে খাদ্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু কোন খাদ্য তা নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি, যেমনটা মহান আল্লাহ বা রাসূল (ﷺ) উল্লেখ করেননি। এর পেছনে হিকমাহ হলো, পৃথিবীর সকল দেশের প্রধান খাদ্য এক রকম নয়। যদি নির্দিষ্ট খাদ্য বাধ্যতামূলক করা হতো, তাহলে তা পালন করা কঠিন হয়ে যেত। আল্লাহ ও তার রাসূল কঠোরতা চান না, বরং সহজ চান। রাসূল (ﷺ) বলেছেন, "তোমরা সহজ কর, কঠিন করো না, সুসংবাদ দাও, ঘৃণা সৃষ্টি করো না।" (সহীহ বুখারি ৬৯, ৬১২৫)।


নবী (ﷺ)-এর একদল সাহাবী, যাঁদের মধ্যে ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) আছেন, এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, অক্ষম ব্যক্তির পক্ষ থেকে প্রতিটি রোজার বদলে একজন মিসকীনকে অর্ধ সা বা দেড় কেজি খাবার দিতে হবে (স্থানীয় খাবার হিসাবে)। (সূরা আল-বাক্বারাহ ২:১৮৩-১৮৪; সহীহ বুখারী, হা/৪৫০৫; নাসাঈ, হা/২৩১৭; মাজমূঊ ফাতাওয়া ইবনু বায, ১৫/২০৪)।


কেউ যদি বলে, এটি তো ফিদিয়ার কথা, যাকাতুল ফিতরের নয়, তবে প্রশ্ন হলো, দেশের প্রধান খাদ্য দিয়ে ফিতরা দিলে কি সুন্নাহ পালন হবে না? হাদীসে কি শুধু খেজুর, যব, কিসমিসের কথা আছে? মুকাল্লিদরা কি এই হাদীসগুলো পড়েননি যেখানে শুধু طعام (খাদ্য) শব্দটি এসেছে? রাসূল (ﷺ) বলেছেন, "তোমরা এক সা খাদ্যদ্রব্য দিয়ে সাদাক্বাতুল ফিৎর আদায় করো।" (সহীহুল জামে, হা/২৪২; সিলসিলা সহীহাহ, হা/১১৭৯)। ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: "আল্লাহর রাসূল (ﷺ) ফিতরা ফরজ করেছেন, যাতে রোজার অনর্থক কথাবার্তা ও অশালীন আচরণ থেকে রোজাদার পরিশুদ্ধ হয় এবং এটি মিসকীনদের খাদ্য হয়।" (আবূ দাঊদ, হা/১৬০৯; ইবনু মাজাহ, হা/১৮২৭)।


উপরের তিনটি হাদীসে তু‘মাতুল লিল মাসাকিন অর্থাৎ মিসকীনদের জন্য খাদ্য উল্লেখ করা হয়েছে, তবে নির্দিষ্ট কোনো খাদ্যের নাম বলা হয়নি। রাসূল (ﷺ) এই পাঁচটি খাদ্যের বাইরেও ফিতরা দেওয়ার জন্য বাধ্যতামূলক কিছু করেননি। চার মাজহাবের কোনো ইমাম কি বলেছেন যে, এই পাঁচটি খাদ্য ছাড়া অন্য খাদ্য দিয়ে ফিতরা দেওয়া জায়েয নয়?


দেখুন, আবু সা‘ঈদ খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে, “আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর যুগে ঈদের দিন এক সা পরিমাণ খাদ্য ফিতরা হিসেবে আদায় করতাম। আবু সা‘ঈদ বলেন, তখন আমাদের খাদ্য ছিল যব, কিসমিস, পনির ও খেজুর।” (সহীহ বুখারী, হা/১৫১০)। ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম (রাহ.) বলেছেন, "মদিনায় এগুলো ছিল তাদের প্রধান খাদ্য। পক্ষান্তরে, কোনো দেশের প্রধান খাদ্য যদি অন্য কিছু হয়, তাহলে তাদের জন্য সেই খাদ্য দিয়ে ফিতরা আদায় করা ফরজ।” (ইলামুল মুওয়াক্কিয়ীন ৩/১২)।


উপরোক্ত হাদীসগুলো অনুযায়ী, যদি কাউকে বাংলাদেশের প্রধান খাদ্য চাল দিয়ে ফিতরা দিতে বলা হয়, সেটাও সুন্নাহ হবে। কারণ হাদীসে طعام (খাদ্য) শব্দটি এসেছে, আর চাল আমাদের প্রধান খাদ্য। যদি কেউ কেবল পাঁচটি খাদ্যকে ফিতরার জন্য প্রযোজ্য মনে করে এবং টাকা বা সা দিয়ে ফিতরা আদায় করে, সেটা তাদের বোঝার সমস্যা, আমাদের নয়।


১২. হানাফীগণ কিয়াসের ভিত্তিতে টাকা দিয়ে ফিতরা আদায়ের দলিল দেন। তবে আল্লামা শানকিতি (রাহ.) বলেছেন, ফিতরা শুধুমাত্র ঈদের দিন দরিদ্রদের ভক্ষণ ব্যবস্থা, তাই ফিতরাকে যাকাতের সাথে কিয়াস করা ঠিক নয়।


Post a Comment

0 Comments